November 21, 2024, 12:23 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া অনলাইন/
এখনও পানি মুক্ত হয়নি খুলনা বিভাগের ৩ জেলার ৯৬ হাজার হেক্টর জমি। ফলে এবছর বোরোর আবাদ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছেন খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরার ১০টি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার কৃষক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলাগুলোর মধ্যে প্রবাহমান নদীগুলোতে অতিরিক্ত পলি জমার কারনে পানি টেনে নিয়ে তা ধারন করার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে নদীগুলোর সাথে সর্ম্পকযুক্ত এসব বিলের পানি-নিষ্কাশন হতে পারছে না।
জেলাগুলোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার ১০টি উপজেলায় প্রায় ৬গটিরও বেশী বিল রয়েছে। যেখানে রয়েছে অন্তত ৯৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। এসব জমির দুই-তৃতীয়াংশ বোরো চাষে এবং বাকিটা মাছ চাষে ব্যবহৃত হয়।
কৃষি দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিগতবছরগুলো তেমন বৃষ্টিপাত ছিল না। কিন্তু এ বছর অক্টোবরের শেষ প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে এসব এলাকা তলিয়ে যায়। সাধারণভাবে জেলাগুলোর সাথে সংযুক্ত নদীগুলো এসব বিল থেকে পানি টেনে নেয়। নদীগুলো হলো মুক্তেশ্বরী টেকা, শ্রী, হরি, শৈলমারী ও সালতা। কিন্তু এবার নদীগুলোর বুক জুড়ে অতিরিক্ত পলিমাটি জমার কারনে পানি টেনে নিতে পারছে না।
এদিকে, কাউন্ট-ডাউন শুরু হয়ে গেছে এসব বিল-বাওরের বোরো আবাদের। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলে এই বোরো আবাদের মৌসুম; চলে ফেব্রুয়ারি মধ্যভাগ পর্যন্ত।
ভয়ানক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছেন ঐ অঞ্চলের কৃষকরা।
স্থানীয় কর্মকর্তা ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার প্রায় ২০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি পানিতে নিমজ্জিত। এর মধ্যে ডুমুরিয়ার বিভিন্ন এলাকার ১১ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে রংপুর, রূপরামপুর, শালুয়া, মিক্সি মিল ও রুদাঘোড়া। এ উপজেলায় বিল ডাকাতিয়াসহ ছোট-বড় ২৪টি বিল রয়েছে। অক্টোবরের শেষেই এসব বিল চাষের উপযোগী হয়ে যায়। কিন্তু সেখানে এখন কোমর পানি। অধিকাংশ মাছের ঘেরও তলিয়ে রয়েছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনশাদ ইবনে আমিন জানান, ‘সাধারণত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে বোরো মৌসুম শুরু হয়। শিগগির আবাদি জমি থেকে পানি নিষ্কাশন করে চাষযোগ্য করে তুলতে হবে। নয়তো কৃষক বোরো মৌসুম ধরতে পারবেন না।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কৃষিনির্ভর গ্রাম বাকা। কপোতাক্ষতীরের এ এলাকার বাসিন্দা ১০ হাজারের বেশি। বাকারচরে জমির পরিমাণ সাড়ে ৭০০ বিঘা।
যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর ও কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে এ ভবদহ অঞ্চল। এ এলাকার প্রায় ৩৫ হাজার কৃষক অন্তত ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করেন।
যশোর অঞ্চলের কৃষক বলছেন, চার দশক ধরে এ অঞ্চলের প্রায় তিন লাখ মানুষ জলাবদ্ধতায় ভুগছে। গত দুই বছর কিছুটা কমলেও এবার ভারী বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা আরো প্রকট হয়েছে।
‘খুলনা পানি কমিটি’র সভাপতি এবিএম শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টির পানি মূলত খাল হয়ে দিয়ে নদ-নদীতে চলে যায়। তবে জেলার বেশির ভাগ খাল দখল-দূষণে নাব্যতা হারিয়েছে। পলি জমেছে নদ-নদীতে থাকা জলকপাটে। ফলে দ্রুত সময়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘পলি জমে ডুমুরিয়া উপজেলার ১১টি নদীর সবই এখন মৃতপ্রায়। এসব নদ-নদীর সঙ্গে যুক্ত খালে ৭৫টি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে ২৩টি জলকপাট অকেজো। ১১টি আংশিক বিকল। প্রায় ২০টি জলকপাটের মুখ পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। বাকি ২১টি সচল থাকলেও খুব একটা কাজে আসছে না।’
এদিকে, এ অঞ্চলের পানি নিস্কাশণ নিয়ে বেশ কয়েকটি সরকারী প্রকল্প কাজ করলেও তেমন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার অতিরিক্ত পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, ২৫টি পাম্প দিয়ে কৃষিজমি থেকে পানি নদীতে ফেলা হচ্ছে। শিগগিরই আরো ১৫টি পাম্প বসানো হবে। তিনি জানান, বিএডিসি এ কাজ করছে।
জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের (দ্বিতীয় পর্যায়) মাধ্যমে যশোর পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০২০ সালের জুলাইয়ে ৫৩১ কোটি টাকায় কপোতাক্ষ নদের খনন শুরু করে। খননকালে বাকা ও আশপাশের বিলের সঙ্গে নদের সংযোগ স্থাপন না করায় এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জি বলেন, ‘বাকা এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে। কপোতাক্ষের সঙ্গে খালগুলো সংযোগ স্থাপন করলে এ সমস্যা আর থাকবে না।’
যশোরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সমরেন বিশ্বাস বলেন, ‘গত কয়েক বছরে ভবদহ এলাকায় বোরো চাষের প্রসার ঘটেছে। তবে এ বছর পরিস্থিতি খুব খারাপ। সব আবাদি জমি পানির নিচে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে পানি কমে গেলে চাষীরা বোরো ধানের আবাদ করতে পারবেন। অন্যথায় যশোরের প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমি এ মৌসুমে অনাবাদি থেকে যেতে পারে।’
এদিকে, সম্প্রতি যশোরের ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সম্প্রতি ভবদহ অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বিলগুলোর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থানীয় আমডাঙ্গা খালের প্রবাহ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে ভবদহ এলাকার হরি নদী, ভৈরব নদ ও মুক্তেশ্বরী নদীতে ড্রেজিং করে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।’
Leave a Reply